বিশেষ প্রতিনিধিঃকাজী মহিদুল ইসলাম
কলকাতা। শিল্পের শহর। সেই শহরে এলেন একজন শিল্পী। নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখলেন, ‘কলকাতা!! আমি আসছি!’ সারা শহর পাগল হয়ে ছুটল সেই শিল্পীকে একবার নিজের চোখে দেখতে, নিজের কানে তাঁর গলার ম্যাজিক শুনতে। পরপর দু’দিন। ২৫০০ মানুষের জায়গায় প্রায় ৮০০০ মানুষ, প্রত্যেকের শ্বাসপ্রশ্বাসে অডিটোরিয়াম গরম হয়ে উঠলো। অডিটোরিয়ামের এসি বন্ধ, এক চরম শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার সৃষ্টি হল। মঞ্চের দুপাশেও অসংখ্য মানুষ, পারফর্ম করার স্পেস পাচ্ছিলেন না শিল্পী। জোরালো আলো নিভিয়ে দিতে অনুরোধ করলেন। জানিনা আলো নিভেছিল কি না, কিন্তু সেই শিল্পী থামেননি।
এরকম পরিস্থিতিতে অসুস্থতা বোধ করা স্বাভাবিক। কিন্তু ওই যে, তাঁরা তো শিল্পী। শিল্পীদের একটা কমিটমেন্ট থাকে তাঁদের শিল্পের প্রতি এবং তাঁদের দর্শক বা শ্রোতাদের প্রতি। তাই শারীরিক কষ্ট নিয়েও শুধুমাত্র কমিটমেন্টের জেরেই আনন্দ দিয়ে গেলেন। কিন্তু শিল্পীরাও তো মানুষ দিনের শেষে। আর পারলেন না। বেরিয়ে গেলেন।
কিছুক্ষণ পরেই এল সেই খবর। যা রাতের ঘুম উড়িয়ে দিল একটা জেনারেশনের। আমার বিশ্বাস, কাল রাতে অনেকেই ঘুমাতে পারেননি। পারলেও অনেক দেরিতে ঘুমিয়েছেন। এবং সেটাই স্বাভাবিক। যে মানুষটা যে শিল্পীটা চিরতরে চলে গেলেন, তিনি যে কেকে। আমার মত প্রায় প্রত্যেকের ছোটবেলার প্রতিটা ইমোশনের সাথে যার নাম জড়িয়ে।
একজন শিল্পীর কাছে মঞ্চের চেয়ে বড় আর কিচ্ছু হতে পারে না। সেই মঞ্চে যখনই তিনি পারফর্ম করেন, সামনের সারি সারি কালো কালো মাথা যখন সেই পারফর্মে সাড়া দেয়; তখনই প্রতিবার শিল্পী নতুন করে বাঁচার রসদ পান। মঞ্চকেই একজন শিল্পী নিজের পুরো জীবনটা দিয়ে যান। ইনিও তাই। জীবনের শেষ মুহূর্তটুকু, নিজের সবটুকু তিনি মঞ্চকেই, দর্শককেই দিয়ে নিঃশব্দে চলে গেলেন। একজন শিল্পীর এর থেকে বড় চাওয়া আর কীই বা হতে পারে? আর এই কারণেই তিনি এক ‘বড় শিল্পী’ তক্মা ছাপিয়ে ‘মহান শিল্পী’ হয়ে গেলেন। এরপর থেকে তাঁর প্রতিটা গান উত্তাল চেউয়ের মত আছড়ে পড়বে বুকে আর তোলপাড় করে দেবে ভেতরটা।
আরও এক শিল্পীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে। তিনি গতকাল জানতে চেয়েছিলেন যে বাঙালিদের বাইরের শিল্পীদের নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন? কেন বাঙালিরা বাঙালি শিল্পীদের নিয়ে এমন উন্মাদনা প্রকাশ করে না? দেখুন, আপনার প্রতিটা কথা সত্য। আপনার একথা মনে হতেই পারে, এবং সেটা কিছুটা হলেও বাস্তব। ঠিক যেরকম ‘বাংলা সিনেমার পাশে দাঁড়ান’ শুরু হয়েছিল, তেমনি ‘বাংলা গায়কদের পাশে দাঁড়ান’ শুরু হত। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু ওই যে আপনি বললেন না একটা তাচ্ছিল্যের সুরে, ‘হু ইজ কেকে ম্যান?’ তখনই আপনার আগের সমস্ত কথা একটা অজ্ঞানতার স্তুপে চাপা পড়ে গেলো। নিজে একজন শিল্পী হয়ে আর একজন শিল্পীকে এভাবে ছোট কেন করলেন তার উত্তর নেই আমার কাছে, আমি জানি আপনার কাছেও হয়তো নেই। হয়তো আপনি অপমান করতে চাননি, কিন্তু করে ফেলেছেন। মানুষ মাত্রেই ভুল করে, কিন্তু সেই ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়া যায়, পাওয়াও যায় হয়তো। কিন্তু আপনি কি আর ক্ষমা চাইতে পারবেন? কার কাছেই বা চাইবেন?
আর একটাই কথা বলার। আর কিছু প্রশ্ন ছিল। ওনার কাছে, যার কোনো উত্তর কোনোদিন পাওয়া জাবেনা। জানি। তাও বলি…
জানিনা কলকাতা শহরে এসে এরকম ভাবে চলে যেতে হল বলে কষ্ট পাবো? নাকি কলকাতা আপনার শেষ গানের সাক্ষী থাকলো বলে গর্ববোধ করবো? ‘হাম রহে ইয়া না রহে কাল’ গান গেয়ে সেটাকে এতটা সত্যি করে দিলেন? এভাবে এক রাতে সারা দেশের একটা জেনারেশনের রাতের ঘুম উড়িয়ে আপনাকে জবাব দিতে হল সেই শিল্পীকে যে ‘হু ইজ কেকে?’ শিল্পী বলে নিজের জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে কমিটমেন্টকে বড় করতে হল? কেন আগেই শো শেষ করে ফিরে গেলেন না বলুন তো? পৃথিবীর সমস্ত শিল্পীদের ‘কমিটমেন্ট’ শব্দটার মানে বোঝানোর দায়িত্ব কি আপনার উপরেই ছিল? অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেলেন। মাথায় রাখবো। আজীবন।
আর একটা কথা। আমাদের ছোট থেকে শেখানো হত, ‘যাচ্ছি’ বলতে নেই, বলতে হয় ‘আসছি’। আপনি বোধ হয় জেনেই লিখেছিলেন না? ‘কলকাতা!! আমি আসছি!’?